বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

হার্ডডিস্কের যেকোনো ড্রাইভ লুকিয়ে রাখুন


হার্ডডিস্কের যেকোনো ড্রাইভ লুকিয়ে রাখুন


আপনার কম্পিউটারে ব্যক্তিগত অনেক তথ্য থাকতেই পারে, যেসব আপনি অন্যদের দেখাতে চান নাসে ক্ষেত্রে চাইলে হার্ডডিস্কের যেকোনো ড্রাইভ লুকিয়ে রাখতে পারেনউইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে চলা কম্পিউটারে এটি খুব সহজেই করা যায় জন্য প্রথমে স্টার্ট মেনু থেকে Run-এ যেতে হবেএর পর সেখানে cmd লিখে এন্টার করুনকমান্ড প্রম্পট চালু হবেকমান্ড প্রম্পট চালু হলে ইউজার নেমের পাশে সবশেষে diskpart লিখে এন্টার করুন
উইন্ডোজ সেভেনের ক্ষেত্রে একটি নোটিফিকেশন আসবেসেটাতে ইয়েস করে দিলেই নতুন একটি কমান্ড প্রম্পট (নতুন উইন্ডো) চালু হবেসেখানে DISKPART> এর পরে লিখুন list volume এবং এন্টার করুনসব কটি ড্রাইভের একটি তালিকা আসবে এখন যে ড্রাইভটি আপনি লুকাতে চান (হাইড) চান, সেটির ভলিউম নম্বর লিখুন লক্ষ করলে দেখতে পাবেন, প্রতিটি ড্রাইভের পাশেই এর ভলিউম নম্বর লেখা আছে যেমনআপনি যদি D:\ ড্রাইভ হাইড করতে চান, তাহলে D:\ ড্রাইভের ভলিউম নম্বর লিখে এন্টার করুনD:\ ড্রাইভের ভলিউম নম্বর ৪ হলে লিখুন DISKPART>-এর পরে লিখুন select volume 4, তাহলে আপনার D:\ ভলিউমটি নির্বাচন করা হবে তারপর লুকানোর জন্য DISKPART>-এর পরে লিখুন remove letter D, তাহলে আপনার নির্বাচন করা ড্রাইভটি লুকিয়ে পড়বেযদি ড্রাইভটি আবার দেখতে চান, তাহলে লুকানো ড্রাইভটি একই পদ্ধতিতে নির্বাচন করে লিখুন assign letter D এবং Command Prompt বন্ধ করে দিনএবারে মাই কম্পিউটারে গেলে ড্রাইভটি আবার দেখতে পাবেনফয়সাল হাসান


সূত্র: দৈনিক প্রথম-আলো, কম্পিউটার প্রতিদিন (হেল্পলাইন) ।

তারিখ: ১৬-০১-২০১২

মুদ্রাস্ফীতি বনাম মূল্যস্ফীতি


মুদ্রাস্ফীতি বনাম মূল্যস্ফীতি


দেশের সার্বিক অর্থনীতি বিষয়ে সাধারণ শিক্ষিত মানুষ, অর্থনীতিবিদ, ভোক্তাসাধারণসবার আলোচনায় যে কথাগুলো ঘুরেফিরে আসে, তা হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বা মূল্যস্ফীতি ইত্যাদিএই দুটি ধারণার সাধারণীকৃত ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে সামান্য বিভ্রান্তিআমরা যখন মুদ্রাস্ফীতি কথাটা ব্যবহার করি, তার সঙ্গে মূল্যস্ফীতির ধারণাকে এক করে ফেলিঅবশ্য এই বিভ্রান্তির কারণও আছেমুদ্রাস্ফীতি বলতে অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধিকেই বোঝানো হয়অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে গেলে এবং পণ্য ও সেবার সরবরাহ অপরিবর্তিত থাকলে মূল্যস্ফীতি ঘটেকারণ অনেক বেশি টাকা সীমিত পণ্য ও সেবার পেছনে ধাওয়া করেএতে চাহিদা ও মূল্যস্তরদুটিই বেড়ে যায়শাস্ত্রীয় ও আভিধানিক অর্থেও মুদ্রাস্ফীতির অর্থ সব ধরনের পণ্য ও সেবামূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধি, যা সাধারণত ঘটে অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহের কারণে, যাতে অর্থের মূল্য হ্রাস পায়বলা হয়, ‘মুদ্রাস্ফীতিতে সবকিছু মহার্ঘ হয়ে যায় কেবলমাত্র অর্থের মূল্য ছাড়াসাধারণ অর্থে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে মূল্যস্ফীতির এটিই সহজবোধ্য সম্পর্ক এবং মুদ্রাস্ফীতির স্বাভাবিক ধর্মটিও এ রকমকিন্তু একে সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত হিসেবে গণ্য করা যায় না
প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্তর কমলেও মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করতে পারে; আবার মুদ্রাস্ফীতি না থাকলেও মূল্যস্তর বাড়তে পারেএককথায়, মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি পেলে অর্থনীতিতে এর একটা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং এর প্রবণতা কোন দিকে যাবে, তা নির্ভর করে একাধিক নিয়ামকের ওপরযেমন, বর্তমান যুগে প্রযুক্তির উ কর্ষের সঙ্গে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সামগ্রী কিংবা মোবাইল ফোন সেটের দাম কমে আসছে এবং সেটা ঘটতে পারে মুদ্রাস্ফীতি বিরাজমান অর্থনীতিতেও আবার একটা মন্দাক্রান্ত অর্থনীতিতে কোনো বিশেষ পণ্য বা সেবার মূল্য বাড়তে পারে, যদি এর চাহিদা কারণবশত হঠা বেড়ে যায়যেমন আমাদের দেশে মুদ্রাস্ফীতির বিপরীত অবস্থা অর্থা মন্দাভাবও যদি বিরাজ করে, তবু ভূসম্পত্তি কিংবা অ্যাপার্টমেন্টের মূল্যস্ফীতি থেমে থাকবে নাকারণ, এর রয়েছে বিশাল চাহিদা, সীমিত সরবরাহ এবং অর্থায়ন প্রাপ্তির সুবিধা
মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে আরেকটি বিষয় গুলিয়ে ফেলা হয়সেটা হচ্ছে ভোক্তা মূল্যসূচকএটি মূলত মূল্যহার পরিবর্তনের হিসাব, যা দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি পরিমাপ করা হয়এই হিসাবের জন্য কোনো একটি নির্দিষ্ট বছরকে ভিত্তি বছর হিসেবে ধরা হয়তারপর সেই ভিত্তি বছরকে বিবেচনায় রেখে একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের মূল্যস্তর পর্যবেক্ষণ করে রেকর্ড রাখা হয়ধরা যাক, মুদ্রাস্ফীতির হার নির্ণয়ের জন্য কেবল একটি পণ্যের মূল্যের ওপর ভোক্তা মূল্যসূচক নির্ধারণ করা হয়এবং ভিত্তি বছর ২০০০ সালে সেই পণ্যটির দাম ছিল এক টাকা এবং এর মূল্যসূচক ১০০পরের বছর (২০০১) সেই পণ্যটির দাম যদি বেড়ে দাঁড়ায় এক টাকা ২০ পয়সায়, তাহলে মূল্যসূচক হবে ১২০এখন আমরা ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যদি মুদ্রাস্ফীতি নির্ণয় করতে চাই এবং ২০১১ সালে সেই পণ্যটির মূল্যসূচক যদি হয় ১৫০, তাহলে এই ১০ বছরে মুদ্রাস্ফীতির হার হবে (১৫০-১২০)১২০ = ০.২৫, অর্থা শতকরা হিসাবে ২৫ শতাংশএ রকম কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ভোক্তা মূল্যসূচক ব্যবহার করে মুদ্রাস্ফীতির হার নির্ধারণ করা হয়কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট বা একক পণ্যের তুলনামূলক মূল্যবৃদ্ধিকে মুদ্রাস্ফীতি বলা যায় না, যদিও একে সাধারণ মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে এক করে দেখা হয়কোনো একক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে সেই পণ্যের বাড়তি চাহিদা কিংবা সরবরাহ ঘাটতির কারণেঅথচ সাধারণ মূল্যস্ফীতি তথা মুদ্রাস্ফীতি চাহিদা সরবরাহের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়এটি নির্ভর করে অর্থনীতির ভাষায় সামগ্রিক চাহিদার ওপরসামগ্রিক চাহিদা বলতে বোঝায়, একটি অর্থনীতিতে পণ্য ও সেবার ওপর সব ভোক্তার মোট ব্যয়, মোট বিনিয়োগ ব্যয়, মোট সরকারি ব্যয় এবং নিট রপ্তানি আয় (আমদানি ব্যয় বাদ দিয়ে)সবকিছুর সমষ্টিআর এই সামগ্রিক চাহিদা প্রভাবিত হয় মুদ্রা সরবরাহ দ্বারাঅতএব, মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে একটি মুদ্রানৈতিক বিষয় এবং এর পেছনে কোনো একক পণ্যের সরবরাহ ঘাটতির কোনো সম্পর্ক নেইবরং সেই পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধির পরও মূল্যস্ফীতি না ঘটে মুদ্রাস্ফীতি বিরাজ করতে পারে কিংবা উভয়ই ঘটতে পারেযেমন, কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে ব্যাপক হারে বেড়েছে মুরগি ও ডিমের উ পাদনকিন্তু এতে কি মূল্য কমেছে? নাকি বেড়েছে? সুতরাং, কোনো একক পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতি কিংবা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় নাসঠিক সংজ্ঞার মুদ্রাস্ফীতিই কেবল সঠিক মুদ্রানীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণযোগ্য এবং সেটি যদি হয় চাহিদাজাত মূল্যস্ফীতিতাহলে মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আরেকটি প্রসঙ্গ স্বাভাবিকভাবেই চলে আসছেসেটি হচ্ছে দেশের মুদ্রানীতি, যা নিয়ন্ত্রণ করে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকমুদ্রানীতি হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে অর্থনীতির গতি ও প্রবৃদ্ধিকে ঠিক পথে চালানোর জন্য মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যা মূলত করা হয় অর্থ সরবরাহ এবং সুদের হারের মাধ্যমে
অন্যভাবে বলতে গেলে, মুদ্রানীতি দিয়ে অর্থনীতির মোট চাহিদার হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটিয়ে চাহিদাজাত মুদ্রাস্ফীতিকে বাগে আনার চেষ্টা করা যায়চাহিদা ব্যবস্থাপনার এই প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মূল্যস্তর ও বিনিয়োগ স্থিতিশীল রাখামুদ্রানীতির এই কৌশল প্রয়োগ করা হয় সুদের হার এবং অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সামগ্রিক চাহিদাকে বশে রাখার জন্যঅর্থ সরবরাহ এবং ঋণ নিয়ন্ত্রণ করলে মুদ্রাবাজারে স্বল্প মেয়াদে সুদ বেড়ে যায় এবং ব্যাংকের বাড়তি তহবিল সংগ্রহের কারণে দীর্ঘ মেয়াদে আমানত এবং ঋণের ওপর সুদ বেড়ে যায়এতে বিনিয়োগ কমে যায়আর এ কারণে অর্থনীতিতে হ্রাস পায় সামগ্রিক চাহিদাহ্রাসকৃত বিনিয়োগের জন্য মানুষের ভোগও কমে যায়, যা আবার প্রভাব ফেলে সামগ্রিক চাহিদার ওপরএতে দেখা যায়, ঋণ সংকোচন করে বিনিয়োগ, মানুষের আয় ও ক্রয়ক্ষমতা কমানো যায়, যে প্রক্রিয়ায় একসময় বশে আসে মুদ্রাস্ফীতি
তবে আজকাল মুদ্রানীতির এই উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা নতুনভাবে আলোকপাত করছেনভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ওয়াই ভি রেড্ডি লেখেন, ‘মুদ্রানীতির উদ্দেশ্য এখন আর মূল্যস্তর স্থিতিশীল রাখায় সীমাবদ্ধ নেই...এর উদ্দেশ্য এখন আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা পর্যন্ত বিস্তৃত
আটলান্টা ফেডারেল রিজার্ভের প্রেসিডেন্ট ডেনিস লকহার্ট বলেন, ‘মুদ্রাস্ফীতি সবকিছুর মূল্য বাড়ায়এটা কোনো একক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি কিংবা কোনো বিশেষ শ্রেণীর পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নয়
তাঁর মতে, নির্দিষ্ট বাজারে পণ্যমূল্যকে নিয়মানুগভাবে প্রভাবিত করতে অক্ষম মুদ্রানীতি একটা ভোঁতা অস্ত্রতাঁর মতে, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক জীবনযাত্রার ব্যয়ের ওঠানামা এবং কোনো একক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে অক্ষমআমরা তেল উ পাদন করি নাখাদ্যও ফলাই নাকিংবা দিই না স্বাস্থ্যসেবাযেসব ঘটনা কোনো কোনো পণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং আপনাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণ ঘটায় যেমন, তেলের অনাগত ধাক্কা কিংবা খরা অথবা ধর্মঘটএসব আমরা ঠেকাতে পারি না
অতএব বাজারধর্মে ঘটা পণ্যের তুলনামূলক মূল্য সংশোধন ঠেকানো মুদ্রানীতির কাজ নয়এর কাজ হচ্ছে অর্থনীতিতে সব মূল্য পরিবর্তনের সামগ্রিক লক্ষ্য ও গতিকে নিয়ন্ত্রণ করাসে কারণেই আমরা দেখতে পাই, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন সুদের হার কিংবা ব্যাংকগুলোর নগদ জমা ও তারল্য হার বাড়ায়, সেটা বাজারের কোনো পণ্যের দাম কমাতে পারে নাতাহলে প্রশ্ন করা যায়, মুদ্রানীতি যদি জীবনযাত্রার ব্যয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে এই নীতির দরকার কী? লকহার্ট এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, দরকারটি হচ্ছে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা এবং দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থিরতা আনা, যা সম্ভব আর্থবাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষার মাধ্যমে
আমাদের দেশেও যখন ষাণ্মাষিক মুদ্রানীতি ঘোষিত হয়, তখন বিভিন্ন মহল থেকে আশা করা হয়, এটি দিয়ে অর্থনীতির সব সমস্যা, যেমন শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে দ্রব্যমূল্য, বিদেশি বিনিয়োগ থেকে শুরু করে টাকার সঙ্গে ডলারের বিনিময়মূল্যসবকিছুর সমাধান করে ফেলা যাবেমুদ্রানীতির কর্মক্ষেত্র যেহেতু চাহিদা ব্যবস্থাপনা, এটি অর্থনীতির সরবরাহ ক্ষমতার ওপর কার্যকর নয়এটি দিয়ে সামগ্রিক চাহিদাকে প্রভাবিত করে এর হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটানো যায়, আর এটি করা হয় সুদের হারের তারতম্য ঘটিয়ে
এই সত্য থেকে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় তা হচ্ছে, কেবল চাহিদাজাত মূল্যস্ফীতিকে মুদ্রানীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়কিন্তু যে মূল্যস্ফীতি ব্যয়বৃদ্ধিজনিত, সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে মুদ্রানীতি অক্ষমযেমন আমাদের অর্থনীতিতে খাদ্যমূল্যস্ফীতি কিংবা মুদ্রাস্ফীতিযা-ই বলা হোক না কেন, ঘটে বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে, কখনোই চাহিদা বৃদ্ধির কারণে নয়, যদিও জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে চাহিদা প্রতিবছর বেড়েই চলেছেসুতরাং মুদ্রানীতি দিয়ে চাহিদা ব্যবস্থাপনা করে খাদ্য কিংবা কোনো একক পণ্যমূল্য কমানো সম্ভব নয়এর আরও একটি কারণ হচ্ছে, খাদ্যের অস্থিতিস্থাপক চাহিদা অর্থা খাদ্যের দাম যা-ই হোক না কেন, মানুষকে তার মৌলিক চাহিদার প্রধানতমটি, অর্থা খাদ্যচাহিদা মেটাতে হবেকিন্তু খাদ্য ছাড়া অন্য পণ্যের মূল্যস্ফীতি কম থাকলেও সার্বিক মূল্যস্ফীতি নির্ভর করে খাদ্যমূল্যের ওপরতাই আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যমূল্যের প্রবণতার ওপর নির্ভর করবে অভ্যন্তরীণ খাদ্যমূল্য এবং তা ঊর্ধ্বমুখী থাকার সম্ভাবনাই বেশিআমাদের দেশে কিংবা ভারতে বিগত বছরগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি বাগে রাখার জন্য ক্রমাগত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এর কোনো সুফল পাওয়া যায়নি, যা প্রমাণ করে যে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় না
তাহলে শেষ পর্যন্ত যে কথাটি বোঝা যাচ্ছে, দেশের মুদ্রানীতি যা-ই হোক না কেন, খাদ্যপণ্যের অভ্যন্তরীণ মূল্য নির্ধারিত হবে আন্তর্জাতিক বাজারের দাম ও চাহিদার স্থিতিস্থাপকতার ওপর, অভ্যন্তরীণ চাহিদার ওপর নয়অতএব, মূল্যসূচক নির্ধারণের জন্য খাদ্যপণ্য প্রধানতম সামগ্রী হলেও এর মূল্য দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নির্ণয় করলে এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক
ফারুক মঈনউদ্দীন: লেখক ও ব্যাংকার




সূত্র: দৈনিক প্রথম-আলো, খোলা কলম

তারিখ: ১৫-০৯-২০১১

বাল্যবিবাহ কমেনি


বাল্যবিবাহ কমেনি


সর্বশেষ বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০০৭-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখনো ১৮ বছরের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে এবং দুই দশক ধরে এ হার প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছেএকইভাবে ৬৬ শতাংশের এক-তৃতীয়াংশ ১৯ বছর বয়স হওয়ার আগেই মা বা গর্ভবতী হচ্ছে
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, বাল্যবিবাহ ছেলে ও মেয়েদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করেএতে ঘটে সুন্দর শৈশবের সমাপ্তি; হরণ হয় নিজস্ব পছন্দ ও স্বাধীনতা; অনুপযোগী যৌন সম্পর্কে বাধ্য করা হয়; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও বিকাশের অধিকার ও সুযোগ খর্ব হয়সব মিলে মেয়েটির মানসিক ও আবেগগত ক্ষত সৃষ্টি হয়, যা সারা জীবনের সুস্থতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) গত বছরে প্রকাশিত প্রোগ্রেস ফর চিলড্রেন এচিভিং দি এমডিজিস উইথ ইকুইটিশীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের আগে ৬৬ শতাংশ মেয়ে এবং একই বয়সের পাঁচ শতাংশ ছেলের বিয়ে হচ্ছে অর্থা, বাল্যবিবাহের কুফল বেশি ভোগ করছে মেয়েরা
স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দারিদ্র্য, অজ্ঞতা, সচেতনতার অভাব, প্রচলিত প্রথা ও কুসংস্কার, সামাজিক অস্থিরতা, কন্যাশিশুর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব, নিরাপত্তার অভাবকে বাল্যবিবাহের জন্য দায়ী করা হয়েছেবাল্যবিবাহের দীর্ঘমেয়াদি কুফল ভোগ করতে হচ্ছে নারীদের
প্রথম আলোয় প্রকাশ, গত বছরের মে মাসে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার শিকটা গ্রামের রোখসানাকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ায় সে আত্মহত্যা করেঅষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় রোখসানাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়কয়েক দিন পর স্বামীর ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসে সেপরে স্বামীকে তালাক দেয়এরপর আবার পড়াশোনা শুরু করে নান্দাইলদীঘি কলেজে পড়া অবস্থায় তার পরিবার আবার দ্বিতীয় বিয়ের জন্য চাপ দেয়মারা যাওয়ার সময় কলেজের রেকর্ড অনুযায়ী, রোখসানার বয়স ছিল ১৬ বছর ছয় মাস নয় দিন
জামালপুর জেলার জামিরা গ্রামের কিশোরী শাপলার সম্প্রতি বিয়ে হয়েছেদশম শ্রেণীতে পড়ুয়া শাপলার স্বামী বিদেশে থাকেনপাত্র ভালো, আর্থিক অবস্থাও ভালোঅন্যদিকে শাপলার পিছু নিয়েছিল গ্রামের বখাটেরাস্কুলে আসা-যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত করত তাকেচিঠি দেওয়া এবং যে ছেলেরা বিয়ের জন্য যোগ্য নয়, তারাও বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো শুরু করেকেননা শাপলা দেখতে সুন্দরশাপলার মা-বাবা মেয়ের বিয়ে দেওয়াকেই নিরাপদ বলে মনে করেছেন বলে প্রথম আলোকে জানান এই শাপলাকেই বিয়ের পর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পরিবারের চাপে হয়তো সন্তান নিতে হবেঅপুষ্ট কিশোরী মা অপুষ্ট শিশুর জন্ম দেবে
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করছেএর পাশাপাশি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইনও আছে১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন পাস করা হয়েছেএ আইন ১৯৮৪ সালে সংশোধন করা হয়আইন অনুযায়ী, বাল্যবিবাহ শাস্তিযোগ্য অপরাধএ আইনে পুরুষের বিয়ের আইনসম্মত বয়স ন্যূনতম ২১ বছর এবং নারীর ন্যূনতম ১৮ বছর নির্ধারণ করা হয়এ বিয়ের সঙ্গে জড়িত বর, কনের অভিভাবক, আত্মীয়, ইমামসহ সবার শাস্তির বিধান আছেজড়িত পুরুষদের এক মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডই হতে পারেতবে কোনো নারীর জরিমানা হলেও জেল হবে নাবর ও কনে দুজনই নাবালক হলে তাদের কোনো শাস্তি হবে নাছেলে সাবালক ও মেয়ে নাবালক হলে ছেলের এক মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডই হতে পারে
এর পরও বিশ্বের মধ্যে বাল্যবিবাহ বেশি সম্পন্ন হওয়া দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম প্রথম দিকেই রয়েছেসেভ দ্য চিলড্রেনের বিশ্বে মায়েদের অবস্থা ২০১০শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ৬৯ শতাংশ নারীর ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০০৭-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারীর বিয়ের গড় বয়স ১৫ বছর তিন মাস২০ থেকে ২৪ বছর বয়সের নারীদের মধ্যে যাঁদের ১৮ বছরের মধ্যে প্রথম বিয়ে হয়েছে, তাঁদের শতকরা হার ৬৬, যা ২০০৪ সালে ছিল ৬৮ শতাংশরাজশাহীতে ৪০, ঢাকায় ৩৩, সিলেটে ২৩, চট্টগ্রামে ২৮, বরিশালে ২৯ এবং খুলনায় ৩৪ শতাংশ নারী ১৫ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে মা হয়েছেন বা প্রথমবার গর্ভবতী হয়েছেনকিশোরী মাতৃত্বের হার ২০০৪ সাল ও ২০০৭ সালের প্রতিবেদনে ৩৩ শতাংশে আটকে আছেএ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৩০ শতাংশ মা এবং ৪১ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে

বাল্যবিবাহের কুফল: জনসংখ্যার ২৩ শতাংশই হচ্ছে ১০ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী২০০৮ সালের পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় যোগাযোগ কৌশলপত্রঅনুযায়ী, কিশোরীদের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার জাতীয় গড়ের প্রায় দ্বিগুণ এবং শিশুমৃত্যুর হার জাতীয় গড়ের প্রায় শতকরা ৩০ ভাগের বেশি
বিশেষজ্ঞদের মতে কিশোরীদের অল্প বয়সে বিয়ে জরায়ুমুখের ক্যানসারের অন্যতম কারণকেননা, এই মেয়েদের জরায়ুমুখের কোষ পরিপক্ব হওয়ার আগেই স্বামীর সঙ্গে যৌনমিলন করতে হয়এতে কোষগুলোতে বিভিন্ন ইনফেকশন হয়ে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়
এনজিও এনজেন্ডারহেলথ বাংলাদেশের প্রসবজনিত ফিস্টুলা এক করুণ অভিজ্ঞতাশীর্ষক প্রতিবেদনে মালেকা, আনোয়ারা, সেলিনাসহ কয়েকজন নারীর বীভস জীবনের কাহিনি প্রকাশ করা হয়েছেএই নারীদের প্রায় সবাই বাল্যবিবাহ ও একাধিক সন্তান জন্ম দিতে বাধ্য হয়েছিলেনপরে শুধু ফিস্টুলার কারণে অভিশপ্ত জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন
সন্তান জন্ম দেওয়া, লালন-পালন, পরিবারের দেখাশোনাএ বিষয়গুলো কিশোরীবধূ ভালোভাবে করতে পারে নাএ জন্য দেখা দেয় নানা জটিলতা
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) যোগাযোগ ব্যবস্থাপক আরিফা এস শারমিন প্রথম আলোকে বলেন, ১২ বা ১৩ বছরের একটি মেয়েকে ২৭ বা আরও বেশি বয়সের একজন পুরুষ বিয়ে করছেনস্বামীর কাছে তাঁর বউ একজন শিশুএকইভাবে শ্বশুরবাড়ির লোকজনও ভাবেন, একে তো শাসন করাই যায়এতে নির্যাতনের মাত্রা বাড়েআর যে কিশোরী-বউ মার খাচ্ছে, তার কথা বলার অধিকার নেইসে ভাবে, এটাই হয়তো নিয়মআর এ ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সেভাবে সামাজিক প্রতিরোধও গড়ে ওঠেনি
আরিফা এস শারমিন জানালেন, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে ইউনিসেফ ২০০৬ সাল থেকে কিশোরী অভিযান নামের একটি কর্মসূচি পরিচালনা করছেবর্তমানে দেশের ৫৯টি জেলায় কর্মসূচিটি চলছেএ পর্যন্ত এক লাখ ৩৪ হাজার কিশোর-কিশোরী এ কর্মসূচি থেকে বাল্যবিবাহের কুফলসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ পেয়েছে
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিবার পরিকল্পনা এবং মা ও শিশুস্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্যকণিকায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কিশোরীদের মধ্যে প্রজননের হার প্রতি হাজারে ১২৬ জনএ বয়সের বিবাহিত কিশোরীদের মধ্যেই অপূর্ণ চাহিদার হার বেশি
আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস কে রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘দরিদ্র পরিবারে কন্যাসন্তানকে বাড়তি বোঝা হিসেবে মনে করা হয়তাদের ধারণা, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলে অন্ততপক্ষে একজনের খাবার কম লাগবেবেশি বয়সে মেয়ের বিয়ে হোক, তা মুরব্বিরাও চান নারাস্তাঘাটে যৌন নির্যাতন বা বখাটেদের পাতের কারণেও অভিভাবকেরা তড়িঘড়ি করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান দেশের কিশোরীদের প্রায় ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশই অপুষ্টির শিকারবিয়ের পরই স্বামী ও অন্যরা সন্তানের মুখ দেখতে চায়এক বা দুই বছরের মধ্যে সন্তান পেটে না এলে স্বামী যদি বংশরক্ষার জন্য আবার বিয়ে করে ফেলে, সে জন্য মেয়ের বাড়ি থেকেও সন্তান নেওয়ার জন্য মেয়েটিকে চাপ দিতে থাকেকিন্তু এই অপুষ্ট মা কম ওজনের সন্তানের জন্ম দেয়নবজাতক মারা যায়মারা না গেলেও মা ও সন্তানের অসুখ লেগেই থাকেচিকিসার খরচ, পরিবারের লোকজনের কাজ কামাই দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি শুরু হয়এতে নেতিবাচক অবস্থা চলতেই থাকে পরিবারটিতে

এ ধরনের উদাহরণ আছে খুবই কম: গত বছরের আগস্ট মাসে প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, অপ্রাপ্তবয়স্ক কনেকে বিয়ে করার দায়ে বর খোরশেদ আলমকে (২৮) জেলহাজতে পাঠিয়েছেন আদালতনোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা তাঁর কার্যালয়ে আদালত বসিয়ে বরকে দুই মাসের সশ্রম কারাদণ্ড এবং এক হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন
এর আগে একই আদালতে অপ্রাপ্তবয়স্ক স্কুলছাত্রীকে বাল্যবিবাহ দেওয়ার দায়ে কনের বাবা আবু তাহের ও মা হোসনে আরা বেগমকে এক হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়পাশাপাশি সরকারি আদেশ অমান্য করার অপরাধে দণ্ডবিধি ১৮৮ ধারায় তাঁদের উভয়কে আরও এক হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়
সহযোগিতার দায়ে বরের বাবা কালা মিয়া ও ভাই জামাল হোসেনকে দুই হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে এক মাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে আদালতের আদেশের পর অভিযুক্ত ব্যক্তিরা জরিমানার টাকা পরিশোধ করে সাজা ভোগ থেকে রেহাই পান
প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, সেনবাগ উপজেলার ডমুরুয়া ইউনিয়নের বাবুপুর-শ্রীপুর গ্রামের কালা মিয়ার ছেলে প্রবাসী খোরশেদ আলমের (২৮) সঙ্গে গত ২৩ জুলাই একই ইউনিয়নের নলুয়া গ্রামের আবু তাহেরের মেয়ে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী তাজ নেহার বেগমের (১৩) বিয়ের দিন ঠিক হয়খবর পেয়ে ইউএনও মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা চিঠি দিয়ে বিয়ে না দেওয়ার জন্য কনের বাবা-মাকে নির্দেশ দেনকিন্তু সরকারি আদেশ অমান্য করে গত ২৯ জুলাই বরের বাড়িতে কনেকে নিয়ে গোপনে কাবিনবিহীন বিয়ে দেওয়া হয়
গত বছরের মে মাসে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বিয়ে দিতে গিয়ে শ্রীঘরে যান ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার নাগারদিয়া গ্রামের এক মামেয়ের বয়স ১৮ বছর না হওয়ায় ইউএনও এস এম আবদুল কাদের গিয়ে বিয়ে বন্ধ করেনইউএনও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাঁকে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেনপরে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়
গত জুলাই মাসে নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের হস্তক্ষেপে বাল্যবিবাহ পণ্ড হয়ে গেছেমেয়েটির বয়স ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তাকে বিয়ে দেবেন না বলে তার বাবা মুচলেকা দিয়েছেন উপজেলার খলিশাউড় গ্রামের ওই মেয়ের (১১) সঙ্গে উপজেলার বিশকাকুনী ইউনিয়নের জামাইকোনা গ্রামের একটি ছেলের (১৬) বিয়ে ঠিক হয়
গত জুলাই মাসে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ওবায়দুল ইসলাম মুদিরগাঁও গ্রামে গিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধের নির্দেশ দেন মেয়েটির বাবা মুচলেকা দেন, মেয়ের বয়স ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে দেবেন না
মেয়ের জন্মনিবন্ধন সনদ অনুযায়ী, এই মেয়ের জন্ম ২০০০ সালের ২০ জানুয়ারি
গত আগস্টে দিনাজপুর শহরের ঘাসিপাড়া মহল্লায় ১৪ বছর বয়সের আসিয়া খাতুনের সঙ্গে শহরের সুইহারী এলাকার মো. মোফাজ্জল হকের ছেলে আবদুস সালামের (২৭) বিয়ের অনুষ্ঠানে দিনাজপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুর রহমান পুলিশ নিয়ে হাজির হয়ে বিয়ে ভেঙে দেনএ সময় বিয়ের কাজি আবদুর রশিদ ক্ষমা প্রার্থনা করলেও ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে দুই হাজার টাকা জরিমানা করেনএ ছাড়া ছেলে ও মেয়ের অভিভাবকেরা সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিয়ে দেবেন না মর্মে মুচলেকা দেন
গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রোগ্রাম ম্যানেজার তপন কুমার দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মেয়েদের শিক্ষায় বাল্য বিয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে কাজ করছেশিক্ষার হার কম হলে বাল্য বিয়ের ঘটনা বেশি ঘটে, আবার বাল্য বিয়ের জন্যই মেয়েরা স্কুল ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেহাওর, চর, পার্বত্য অঞ্চলে বাল্য বিয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে সরকারকে কিশোরীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি হাতে নিতে হবেএকই সঙ্গে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেয়েদের জন্য কারিগরি শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে সরকার কাজ করছে, তবে আরও অনেক কিছু করার আছে বা করতে হবেতিনি বলেন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রচার, প্রচারণা, প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেএ ছাড়া কোনো জায়গায় বাল্যবিবাহ হচ্ছেখবর পেলেই তা প্রশাসনের মাধ্যমে বন্ধ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছেতবে ফলাফল এখনো ততটা আশাব্যঞ্জক নয়এ ছাড়া বেশির ভাগ বিয়েই হচ্ছে গোপনে বা সবার অগোচরে অভিভাবকদের ধারণা, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলে আর কোনো দায়িত্ব নেইএ ছাড়াভালো পাত্রপাওয়া গেলেও অভিভাবকেরা দেরি করতে চান নাকেননা, ভবিষ্যতে যদি আর বিয়ের জন্য এ ধরনের ছেলে না পাওয়া যায়!

সূত্র: দৈনিক প্রথম-আলো, নারীমঞ্চ
তারিখ: ২১-০৯-২০১১

কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য: অভিভাবকদের করণীয়


কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য: অভিভাবকদের করণীয়



গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা
১৬ জানুয়ারি প্ল্যান বাংলাদেশের সহযোগিতায় ও প্রথম আলোর আয়োজনে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য: অভিভাবকদের করণীয়শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা আলোচনায় অংশ নেনতাঁদের বক্তব্য এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে ছাপা হলো

যাঁরা অংশ নিলেন :

এম এম নিয়াজ উদ্দিন
মহাপরিচালক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
ডা. মোহাম্মদ শরীফ
ডিরেক্টর, এমসিএইচ সার্ভিস ও লাইন ডিরেক্টর (এমসিআরএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
ডা. জহির উদ্দিন আহমেদ
সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি
প্রফেসর এ কে এম নূর-উন-নবী
প্রকল্প পরিচালক, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. মেহতাব খানম
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ডা. ইশরাত জাহান
কর্মসূচি ব্যবস্থাপক (এআরএইচ), পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর
ডা. সেলিনা আমিন
কান্ট্রি প্রজেক্টস ম্যানেজার, প্ল্যান বাংলাদেশ
অ্যাডভোকেট সালমা আলী
নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি
ডা. কামরুন নাহার
সহযোগী বিজ্ঞানী, আইসিডিডিআরবি
সৈয়দা সেলিনা পারভীন
দলনেতা, প্রিসেট প্রজেক্ট, হাসাব
ডা. রাবেয়া খাতুন
ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার, কৈশোর স্বাস্থ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
ডা. তাহমিনা মির্জা
প্রকল্প ব্যবস্থাপক, কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য, প্ল্যান বাংলাদেশ
লায়লা রহমান
জ্যেষ্ঠ কর্মসূচি কর্মকর্তা, পপুলেশন কাউন্সিল
ডা. ইফতেখার হাসান খান
স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, প্ল্যান বাংলাদেশ

সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম: যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

আলোচনা :

আব্দুল কাইয়ুম
কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়টি সাধারণত আলোচনায় আসে নাএকজন শিশু যখন বড় হয়, তখন তার শরীর ও মনে কিছু পরিবর্তন আসেএ পরিবর্তনটা তার কাছে নতুন মনে হয়এ সময় সে কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়তাকে কোনো বিশ্বাসযোগ্য উ থেকে জানতে হবে যে তার সমস্যাটা কী, করণীয় কী এবং সমাধানটা কীএ জায়গাটায় একটা বিরাট শূন্যতা আছেঅভিভাবকেরা মনে করেন, এটাতে বলার কী আছে, আবার বলতে গেলে হিতে বিপরীতও হতে পারেএসব বিষয়ে আলোচনা করছেন প্রধান অতিথি, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এম এম নিয়াজউদ্দিন

এম এম নিয়াজউদ্দিন
কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সিটি করপোরেশনের বস্তি এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক কিশোর-কিশোরী সাধারণ শিক্ষা থেকে বঞ্চিততাদের মধ্যে এ প্রচার আরও বেশি করা দরকারবাংলাদেশ সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে প্রকল্প রয়েছেআমাদের কর্মীরা মাঠপর্যায়ে কাজ করেনকিন্তু আমি মনে করি, এটা যথেষ্ট নয়কারণ তাঁরা সব কিশোর-কিশোরীর কাছে যেতে পারছেন নাশিশুরা যখন কৈশোরে পদার্পণ করে, তখন তাদের শারীরিক পরিবর্তন হয়এ পরিবর্তনটা মোকাবিলা করার যথেষ্ট জ্ঞান যদি না থাকে, তাহলে অনেক সময় তারা বিপথগামী হবেএকসময় এটা জীবনের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করবে
এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবেকিন্তু অভিভাবকেরা ছেলেমেয়ের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করতে ইতস্তত বোধ করেনতার থেকে বড় কথা হলো, অনেক অভিভাবক জানেন না বিষয়টি কী এবং কীভাবে আলোচনা করতে হবে এমনকি যাঁরা শিক্ষিত, তাঁরাও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে ছেলেমেয়ের সঙ্গে আলোচনা করেন নাআমাদের মন্ত্রণালয় থেকে প্রজননস্বাস্থ্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটি ছোট বই প্রকাশ করার ব্যবস্থা হয়েছে
আমাদেরই অফিসের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বললেন যে তিনি একটা বই গোপনে তাঁর সন্তানের টেবিলে রেখে আসবেনএকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাঁর সন্তানের সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করতে পারছেন নাশুধু উনি কেন, আমরা অনেকেই পারছি না থেকে সাধারণ মানুষের অবস্থা খুব সহজেই বোঝা যায়
এদিক থেকে আমাদের মায়েরা কিছুটা এগিয়ে আছেনতাঁরা প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে মেয়েদের সহযোগিতা করেনআমি তাঁদের প্রশংসা করিকিন্তু ব্যাপক প্রচার ছাড়া এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়আমরা আপনাদের পরামর্শ এবং সহযোগিতা চাই আপনাদের পরামর্শ সরকারকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবেএ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেদুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’, ‘মা ও শিশুর যত্ন নিন’, ‘কিশোর-কিশোরীদের সহযোগিতা করুন’—এ স্লোগানগুলো খুব ছোট করে গণমাধ্যমগুলো যদি তাদের প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ করে, তাহলে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না কিন্তু জাতির অনেক উপকার হবে

সেলিনা আমিন
কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য ও অভিভাবকদের করণীয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিশোর-কিশোরীদের সঠিক তথ্য জানার জন্য এখন কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করছে ব্যাপারে সরকারও একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছেসরকারের পক্ষ থেকে একটি কর্মকৌশলপত্র বের করা হয়কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য-সম্পর্কিত অনেক বিষয় এখানে খুব ভালোভাবে উল্লেখ থাকেযেমন, কী করতে হবে, কখন করতে হবে, কীভাবে করতে হবেকিশোর-কিশোরীদের সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য এটি খুব সহযোগিতা করেঅতএব, এটিকে আমরা সামনে নিয়ে আসতে পারি২০০৬ সালে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে একটি গবেষণাপত্র বের করা হয়েছিলসেখানে কিশোরদের সঙ্গে বাবা-মায়ের আচরণের ধরন (গুড প্যারেন্টিং) উল্লেখ আছেযেমন, একেক বয়সে সন্তানদের সঙ্গে একেক রকম আচরণ করতে হবেসন্তানদের মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করতে হবে তাদের ভালো পরিবেশ দিতে হবেতারা যেন ভাবতে পারে বাবা-মা তাদের বন্ধু তাদের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতে হবেবাবা-মায়ের মধ্যে সব সময় হাসিখুশি সম্পর্ক থাকবেআরও নানা দিক এখানে উল্লেখ আছেআমরা প্ল্যান বাংলাদেশ থেকে কিশোর-কিশোরীদের জন্য প্রজননস্বাস্থ্য পরামর্শসহ কিছু সেবাদানের ব্যবস্থা করছি

আব্দুল কাইয়ুম
আলোচনা থেকে একটি বিষয় বেরিয়ে আসছে, তা হলো, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মা-বাবার খুব যত্ন নিয়ে কথা বলতে হবেশিক্ষা অধিদপ্তরের পাঠ্যপুস্তুকেও এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবেএবার বলবেন ডা. তাহমিনা মির্জা

তাহমিনা মির্জা
বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের এক-পঞ্চমাংশ কিশোর-কিশোরীএদের বয়স ১০ থেকে ১৯ বছরের মধ্যেএদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ বিবাহিতএরা প্রজনন-প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টকিন্তু প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে তাদের অনেকের সঠিক ধারণা নেই জন্য তারা গ্রাম্য চিকিসক, হকার-কবিরাজ ও বন্ধুদের কাছে যায়সেখানে তারা প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে বিপদে পড়েএ বিষয়ে মা-বাবাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবেতাঁরা যদি না জানেন, তাঁদের নিয়ে কর্মশালার ব্যবস্থা করতে হবেপ্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে আমাদের কর্মশালা হয়একজন মা কর্মশালা করার পর তাঁর মেয়েকে পাঠানকারণ তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর মেয়ের জন্য এটি কত জরুরি গবেষণায় দেখা যায়, যেসব কিশোর-কিশোরী বাবা-মায়ের আদর-যত্ন কম পায়, তারা মাদকাসক্ত হওয়াসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লিপ্ত হয়যারা বেশি পারিবারিক সহায়তা পায়, তাদের মধ্যে এ প্রবণতা কমযেসব মা-বাবা প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে বাসায় বা বাড়িতে কথা বলেন, তাঁদের সন্তানেরা অনেক পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করে

জহির উদ্দিন আহমেদ
ছেলেমেয়ে এবং অভিভাবক সবার জন্য অবাধ তথ্যের ব্যবস্থা করতে হবে কিশোর-কিশোরীদের যত বেশি তথ্য দেওয়া যাবে, তারা তত বেশি উপকৃত হবেতথ্যের অভাব থাকলে নানাবিধ কুসংস্কার তাদের ঘিরে ধরবেকিশোর-কিশোরীদের প্রজননতন্ত্র আলাদা এবং এর কার্যাবলিও ভিন্নফলে এর গঠন ও কার্যাবলি সম্পর্কে তাদের জানতে হবেঅবাধ মিলনের ফলে নানা রোগের সংক্রমণ ঘটেএখনো বাংলাদেশের মেয়েরা স্বাস্থ্যসম্মত শোষক-পেটি (স্যানিটারি ন্যাপকিন) লুকিয়ে রাখে অন্ধকারে, স্যাঁতসেঁতে জায়গায়, বালিশের নিচে, এ ব্যাপারে সতর্ক না হলে এ থেকেও মারাত্মক রোগ সংক্রমিত হতে পারেএ বিষয়ে জ্ঞান না থাকলে তারা ক্ষতির সম্মুখীন হবেঅল্প বয়সে বিবাহের কারণে কিশোর-কিশোরীরা নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ছেলেরা মাদকাসক্ত হওয়াসহ বিভিন্ন অসামাজিক কাজে জড়িত হয়বিভিন্ন কারণে মেয়েদের শরীরে পুষ্টির অভাব থাকে, শরীর দুর্বল থাকে অবস্থায় গর্ভধারণের মতো ঝুঁকি নিতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়হস্তমৈথুন, স্বপ্নদোষ শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়, কৈশোরের স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া যদি মনে করা হয়, এর কারণে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি, তাহলে ক্ষতি হতে পরেএখানে তথ্যের অভাব রয়েছেকিশোর-কিশোরীদের বিভিন্ন তথ্য সামগ্রিকভাবে উপস্থাপন করা দরকারতাহলে তাদের মধ্যে একটা ভালো ধারণা গড়ে উঠবেদেশের সব অভিভাবককে, কিশোর-কিশোরীকে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে, আমরা একটি ভালো জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারব

সালমা আলী
প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে যতটা আলোচনা হওয়া দরকার সেটি যেমন হয় না, তেমনি এ বিষয়টিও আমাদের সবার কাছে পরিষ্কার নয়আমরা অভিভাবকদের করণীয় নিয়ে কথা বলছিকিন্তু কত শতাংশ অভিভাবক এ বিষয়টি জানেন তা নিয়ে রয়েছে বড় প্রশ্ন বাংলাদেশ সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারে কিছু অধিকার আছে, যেগুলো বাস্তবায়নের জন্য আমাদের কিছু কর্মপরিকল্পনা নিতে হবেক্লিনিকগুলো সহিংসতার বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে চুক্তি করেছিল, কিন্তু কোনো দিন তারা একটি ঘটনা নিয়েও আসেনিআমাদের দেশের সামাজিক অবস্থা এখনো ওই পর্যায়ে যায়নি যে বাবা-মায়েরা তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করবেন আমি মনে করি, এ বিষয়ে কাজ যতটুকু হচ্ছে, তা দিয়ে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয় ক্ষেত্রে দরকার ব্যাপক শিক্ষার উন্নতি, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে একটি বিস্তৃত পাঠক্রমকিন্তু এখন যা আছে, সেটিও পড়ানো হয় নাশিক্ষকেরা বলেন, বাসায় পড়ে নিয়োনারীর প্রতি বৈষম্যমূলক সনদে সুপারিশের কারণে নারীবান্ধব হাসপাতাল, শিশুবান্ধব হাসপাতাল করা হয়েছে, কিন্তু সেটা কী অবস্থায় চলছে, তার কোনো খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে না সমতাভিত্তিক স্বাস্থ্য-পুষ্টির বিষয়টি এখনো সেভাবে নিশ্চিত হয়নি
পারিবারিক সুরক্ষা ও প্রতিরোধ আইনে বৈবাহিক ও দৈহিক মিলনের বিষয়টি খুব ভালোভাবে এসেছে, যৌন হয়রানির কথা এসেছেযেমন, স্বামী যদি যৌন নির্যাতন (অ্যাবিউজ) করে সেটা কিন্তু অ্যাবিউজ নয়, কিন্তু সে বিষয়টিও এখানে এসেছে
যৌন নির্যাতনের মধ্যে জোর করে এবং অল্প বয়সে বিয়ের বিষয়টি আছেশুধু এটি নয়, মানসিক নির্যাতনের বিষয়টিও এখানে এসেছে
যৌন হয়রানি নিয়ে একটি যুগান্তকারী দিকনির্দেশনা (গাইড) আসছে, যেটি কিশোরীদের অনেক অধিকার নিশ্চিত করবেএখানে বাড়ি, কর্মক্ষেত্র, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গায় নারীদের অধিকার যেন নিশ্চিত হয়, সে ব্যবস্থা আছেএখন সময় এসেছে প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়টি নিয়ে ব্যাপকভাবে ভাবার প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা করতে হবেসেটি বাড়িতে ও স্কুলে উভয় জায়গাতেই হওয়া উচিতযৌন হয়রানি নিরসনে ভুক্তভোগীকে সহায়তা দিতে হবেযখন একজন ভুক্তভোগী আসবে তাকে আদালত, পুলিশ স্টেশন থেকে শুরু করে সব জায়গায় তার প্রাপ্য অধিকারটুকু দিতে হবে

মোহাম্মদ শরীফ
কৈশোরস্বাস্থ্য নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আলোচনা হচ্ছেপরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবছর বিভাগীয় শহরগুলোতে একবার কর্মশালার আয়োজন করা ছাড়া খুব একটা কাজ হয় নাএ বার্তা নিয়ে কীভাবে প্রান্তিক পর্যায়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে আমরা কাজ করছি
এটি বাস্তবায়ন করতে আমাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে যেতে হবেঅভিভাবকদের পাশাপাশি বড় ভূমিকা স্কুলশিক্ষকদের, তাঁদের প্রশিক্ষিত করতে হবেএর জন্য আমরা কিছু বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিয়েছিমাতৃমৃত্যুর একটি বড় কারণ হলো, কৈশোরে গর্ভধারণের মতো ঘটনাএ জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাভাবিক সন্তান প্রসব নিয়ে অধিদপ্তর থেকে আমরা কাজ করছিএতে স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করার হার বেড়েছে
সারা দেশে স্কুল ও মাদ্রাসার প্রধানদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল সেখানে কৈশোরস্বাস্থ্য ও যৌনতা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হয়তাদের আগ্রহে বিষয়গুলো এখন পুস্তক আকারে প্রকাশের কাজ চলছে
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচার দরকারএখনো অনেক বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছেঅনেক বাবা নিরাপত্তা ও সুপাত্রের জন্য মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেনএ জন্য সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে

নূর-উন-নবী
আমাদের জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের পড়ার একটা অংশ আছে দেখে শেখামাস খানেক আগে আমরা উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলামসেখানে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপজেলা সহায়তাকেন্দ্রসহ কমিউনিটি হাসপাতালে আমরা গিয়েছি
কমিউনিটি ক্লিনিক যখন যাত্রা শুরু করে, এর অবস্থা তখন ভালো ছিল নামানুষের ধারণা জন্মেছিল, এটি একটি ছোট হাসপাতালযেহেতু উপজেলা ও ইউনিয়নে একটি করে হাসপাতাল আছেএ বিষয়ে তাদের ধারণার অভাব ছিল, কমতি ছিল সচেতনতারওঅনেকে ভাবতেন এটি যেহেতু ছোট হাসপাতাল, তাহলে ছোট রোগের ওষুধ পাওয়া যাবে
কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সচল রাখতে হলে সমাজের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবেআর এ সম্পৃক্ততা গড়তে একটি সমর্থক দল (সাপোর্ট গ্রুপ) থাকতে হবেকমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর অবস্থান কোথায় হবে, এটি একটি বড় বিবেচ্য বিষয়যেমন একটি বিদ্যালয়ের পাশে এ রকম ক্লিনিক থাকলে কিশোর-কিশোরীরা সহজে বিভিন্ন উপদেশ-সেবা পেতে পারে
আমরা যে আলোচনাগুলো করি, তা সাধারণত বিমূর্ত পর্যায়ে, তার কার্যকর প্রতিফলন কী হবে, তা অনেক সময় বুঝতে পারি না, দেখতেও পারি নাআমরা যাদের জন্য পরামর্শ, সিদ্ধান্ত দিচ্ছি; তাদের এসব বিষয়ে অংশগ্রহণ করাতে হবেকারণ, যে পরামর্শ তাদের জন্য দেব, সেটি যেন নির্দেশমূলক না হয়, তা যেন অংশগ্রহণমূলক হয়
সামাজিক উন্নয়নে আমরা অন্যান্য দেশের তুলনায় অগ্রগতি অর্জন করলেও এ বিষয়ে আমরা খুব অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনিআমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগেও যেমন এ বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা হতো, বর্তমান সময়েও তা-ই হচ্ছে
সন্তানদের সঙ্গে অভিভাবকদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবেপ্রত্যেক অভিভাবকের দায়িত্ব হবে কোনোভাবেই যেন কোনো সিদ্ধান্ত সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া না হয়ছোটবেলা থেকে স্বাধীনচেতা করে গড়ে তুলতে হবে
বিয়ের বয়স নিয়ে যে আইন আছে, তাতে একটি মৌলিক ত্রুটি রয়েছেআইনে নারীর ক্ষেত্রে ১৮ বছরে বিয়ে দিতে বলা হয়েছেযদি কেউ এর ব্যত্যয় ঘটায় তাহলে মা-বাবার শাস্তি হচ্ছে, কিন্তু বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাচ্ছেআরও দেখা যায়, কাবিননামায় লেখা হচ্ছে ১৮ বছর কিন্তু সত্যিকারের বয়স হচ্ছে ১৩ বা ১৪ জন্য জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক অনুশীলন করতে হবে

লায়লা রহমান
আইনগতভাবে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছরআবার সরকার ঘোষণা করেছে, ১৮ বছর পর্যন্ত ছেলেমেয়েকে শিশু বলা হবেতাহলে আমরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই শিশুর বিয়েকে সমর্থন করছিআইন আসলে একটি দিকনির্দেশনা দেয়; আইন যে পুরোপুরি অনুশীলন করা হয়, এমনটি নয়আমরা সবাই এটি মেনে চলছি, তাই কেউ এর দায় এড়াতে পারি না
১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ আইসিপিডি কর্মসূচিতে স্বাক্ষর করেতখন থেকে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছেএর জন্য কৃতিত্ব আছে সরকার, সাহায্যকারী সংস্থা ও এনজিওগুলোরসেই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে পপুলেশন কাউন্সিল অন্যান্য অংশীদারের সঙ্গে একটা গবেষণা করেছিলএতে দেখা গেছে, শুরুতে অভিভাবকেরা প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে সন্তানদের সঙ্গে কথা বলতে চান না; তাঁরা এটা শিক্ষকদের দায়িত্ব বলে এড়িয়ে যানকিন্তু কিছুদিন পর তাঁরা এ বিষয়ে জানতে ও জানাতে আগ্রহী হনএখানে আমরা যাঁরা কথা বলছি, আমাদের কিন্তু দীর্ঘ প্রশিক্ষণ ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ পরিবর্তন এসেছে অতএব, অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য মিডিয়া ও শিক্ষকেরাও বড় ভূমিকা রাখতে পারেনসে জন্য সংবেদনশীল ও উপস্থাপনের দক্ষতা আছেএমন শিক্ষক নির্বাচন করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে
প্রজননস্বাস্থ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যৌনস্বাস্থ্যকিন্তু এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য দিতে আমরা সংকোচ বোধ করিবয়ঃসন্ধিকালে শরীরে বিভিন্ন পরিবর্তন ও যৌন অনুভূতি হয়এটি প্রাকৃতিক নিয়মএর জন্য এ বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য জানতে ও জানাতে হবেপপুলেশন কাউন্সিলের ওয়ান কারিকুলাম বইটি প্রজনন ও যৌনস্বাস্থ্য এবং অধিকার বিষয়ে সম্যক ও সমৃদ্ধ দিকনির্দেশনা দেয়, যাতে ঝুঁকি এড়িয়ে সুস্থ ও আনন্দময় জীবন যাপন করা যায়বইটি যে কেউ কাজে লাগাতে পারে

রাবেয়া খাতুন
আমাদের প্রথম যেটি সক্রিয় হস্তক্ষেপের কেন্দ্র হওয়া উচিত, সেটি হচ্ছে নিজ ঘরআসলে ঘর থেকেই সক্রিয় হতে হবে, যেখানে মা-বাবা প্রধান ভূমিকা পালন করেনকৈশোরস্বাস্থ্যে কিছু সুস্পষ্ট প্রভাব অভিভাবকদের কাছ থেকে আসেএর জন্য নিয়ন্ত্রিত আচরণ, পারিবারিক শ্রদ্ধা ও যথোপযুক্ত ব্যবহার অভিভাবকদের করা উচিতঅভিভাবকদের যা করণীয় তা যথাযথভাবে পালন করলে কিশোর-কিশোরীরা সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারবে এবং এর মাধ্যমে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে তাদের জীবনের জন্য
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সব সময় সরকারকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে থাকেএখন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে আমরা কৈশোরস্বাস্থ্যকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে চাচ্ছিবাংলাদেশে এইচপিএনএসডিপিতে এ বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছেগত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) সম্মেলনে আমরা কিছু অঙ্গীকার করেছি, ২০১৫ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেএর মধ্যে কৈশোরস্বাস্থ্য নিয়ে আমরা অঙ্গীকার করেছি সেবা দেওয়ার জন্যএ ছাড়া বাল্যবিবাহ, অকাল গর্ভধারণ বন্ধে আমাদের কিছু অঙ্গীকার আছেএর জন্য আমরা প্রশিক্ষণ কাঠামো তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছিসরকারকে এ বিষয়ে আমরা সহায়তা করেছিতারাও এগিয়ে এসেছেস্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত দুটি অধিদপ্তর যদি একসঙ্গে এগিয়ে আসে, তাহলে আমরা কৈশোরস্বাস্থ্য নিয়ে যে অঙ্গীকার করেছি, তা বাস্তবায়নে সুবিধা হবে
সন্তান লালনপালনে অভিভাবকদের ভূমিকা কী হবে, তার দিকনির্দেশনা দরকার ব্যাপারে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা যে কাজ করবে, তা নিয়ে আমাদের কিছু দিকনির্দেশনা আছেবাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এখন তা করতে চেষ্টা করব

ইশরাত জাহান
আমাদের প্রজননস্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিষয়ের গভীরে ঢুকতে হবেতা ছাড়া এর পরিবর্তন সম্ভব হবে নাএ জন্য সঠিক তথ্য জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে অভিভাবক ও শিক্ষকদের এর মধ্যে অবশ্যই সম্পৃক্ত করতে হবেতা ছাড়া সম্প্রদায়ের ভূমিকা তো থাকতেই হবে
আমাদের অধিকাংশ অভিভাবকই চিকিসার বিষয়ে খুব বেশি শিক্ষিত ননঅতএব কোন তথ্য দেব, কখন দেব, তা নিয়ে ভাবতে হবেতাঁদের তথ্য সরবরাহ করার মাধ্যমে শিক্ষিত করে তুলতে হবেআর বিদ্যালয়ের শিক্ষক শুধু শিক্ষকই নন, তিনি একজন অভিভাবকও বটেসে জন্য অভিভাবক ও শিক্ষক দুই পক্ষকেই কাজে লাগাতে হবে
আমরা যখন সচেতনতা বৃদ্ধি করতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচারণা চালিয়েছি, কৈশোরস্বাস্থ্যের যে পরিবর্তন তা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেছিএতে দেখা গেছে, মসজিদের ইমামসহ সবাই এ বিষয়ে খোলামেলা জানতে চেয়েছেনসুতরাং নীতিনির্ধারকদের কিন্তু আরও এগোতে হবে

কামরুন নাহার
আমি অভিভাবকদের করণীয় বিষয়গুলো দুই ভাগে ভাগ করিপ্রথমত, অভিভাবকেরা নিজেরাই জানেন না, তাঁদের জানা দরকারদ্বিতীয়ত, তাঁরা আসলে কিশোর-কিশোরীদের কী তথ্য জানাবেন?
বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীর শারীরিক ও মানসিক নানা পরিবর্তন আসেএ সময় তাদের এ পরিবর্তন নিয়ে জানার আগ্রহ তৈরি হয়এ ক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ঠিক রেখে তাদের এ তথ্যগুলো দিতে হবেআজ বিশ্বায়নের যুগে তারা নানাভাবে তথ্য পাচ্ছে, কিন্তু কোন তথ্য আমাদের সংস্কৃতির জন্য উপযুক্ত, সে জিনিসটি মাথায় রাখতে হবে
কোন বয়সে কোন তথ্য দরকার, এটি নির্দিষ্ট করে তথ্য প্রদান যদিও কষ্টসাধ্য; তবু এ কাজটি করতে হবেআমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, একজন বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর বা কিশোরী তাদের অভিভাবক অথবা শিক্ষকদের কাছ থেকে স্বাস্থ্যগত তথ্য পাওয়ার চেয়ে তারা নিজেদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়াকে উপযুক্ত ভেবেছেযেমনএ বিষয়ে তারা যদি একটি বই পড়ে তাহলে কিন্তু আর অভিভাবক বা শিক্ষকের কাছে যেতে হচ্ছে না
এ মুহূর্তে আইসিডিডিআর,বি বয়ঃসন্ধিকালীন কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে গবেষণা করছে একজন কিশোর বা কিশোরী প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কোনো তথ্য দিতে গেলে কী কী বিষয়ে, কীভাবে দিলে তাদের জন্য ব্যবহারযোগ্য হয় এবং তা বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে কতটা উপযোগী, এসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণআমরা যদি প্রত্যেকে নিজেদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করি, তাহলেই এ বিষয়গুলো সহজ হয়ে আসবে

ইফতেখার হাসান খান
আমরা মূলত ঐতিহ্যগতভাবেই প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করি দেশের জনসংখ্যার ২৩ শতাংশই কিশোর-কিশোরী আর প্রতি এক হাজার জন গর্ভবতী মহিলার মধ্যে দেখা যাচ্ছে ছয়জন কিশোরী গর্ভবতী, যার সঙ্গে আবার বাল্যবিবাহ জড়িতবাংলাদেশে চার কোটি কিশোর-কিশোরী আছেবাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কারণগুলো অন্যতমএ ছাড়া অনেকে বাল্যবিবাহের কুফল এবং আইনগত বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে জানে না
বাল্যবিবাহ বন্ধে জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা, বিয়ে নিবন্ধন করা দরকার ছাড়া সরকারি ও বেসরকারিভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে এবং প্রচলিত আইনের সঠিক প্রয়োগ জরুরি
কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য-সম্পর্কিত তথ্য সর্বজনীন করতে মুঠোফোন সেবাদাতা কোম্পানিগুলো এগিয়ে আসতে পারেতারা হটলাইনের মাধ্যমে বিনা মূল্যে এ সেবা দিতে পারেএর বাইরে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ের পড়া বাধ্যতামূলক করা যেতে পারেসেই সঙ্গে পাঠ্যপুস্তকে প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে অধ্যায়দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে

সৈয়দা সেলিনা পারভীন
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে অন্তত ১০ বছর ধরে কাজ হচ্ছেএতে যে সমস্যাগুলো দেখা গেছে তার প্রধান হলো, কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা, ধরে রাখাযেহেতু এটি প্রকল্পভিত্তিক হয়ে থাকে, তার মেয়াদ শেষ হলেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়
এ ক্ষেত্রে কেবল সরকারই পারে প্রকল্পগুলোর দীর্ঘমেয়াদি রূপ দিতেস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত যে অধিদপ্তর দুটি আছে, তাদের যে মাঠকর্মী এবং অবকাঠামো আছে, তা একটি বিরাট সুযোগমাঠকর্মীদের কাজের মধ্যে এ বিষয়টি সংযোজন করা যেতে পারে
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে আমাদের পৌঁছাতে হবেএ জন্য কর্মশালা, আলোচনা ইত্যাদি চালিয়ে যাওয়াতার সঙ্গে দুটি বিষয় যোগ করতে হবেপ্রথমত, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাঠকর্মীদেরদ্বিতীয়ত, গণমাধ্যম, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়াকারণ, সংবাদপত্র পড়তে হলে পাঠককে শিক্ষিত হতে হবে, কিন্তু টিভিতে প্রচারিত তথ্য সবার জন্যই বোধগম্য

মেহতাব খানম
আমরা সবাই গণমাধ্যমের কথা বলছিআমরা জানি, অধিকাংশ গণমাধ্যম কীভাবে চলছে, তাদের মান কেমনআর সেখানে যাঁরা কাজ করছেন, সেসব গণমাধ্যমকর্মী এ বিষয়ে শিক্ষিত কি না, তা আগে দেখতে হবে
প্রথমত, তাঁদের মনের উন্নতি ঘটাতে হবেআরেকটি বিষয় হলো, গণমাধ্যমগুলোতে নেতিবাচক খবর বেশি প্রচার হয়আমরা কেন ইতিবাচক খবর পরিবেশন করব নাশুধু বাল্যবিবাহ হলেই খবর প্রচারিত হবে, যেসব অভিভাবক বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন না, তাঁদের নিয়ে কেন খবর হবে নাএ দেশে এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সঠিকভাবে সন্তান লালনপালন পদ্ধতি (প্যারেন্টিং)এটি নিয়ে কাজ করতে হবেকারণ, আমরা ভুলভাবে বাচ্চাদের বড় করছিআজকাল ছাত্রছাত্রীদের শাস্তি নিয়ে কথা হচ্ছে কিন্তু সন্তানের ওপর মা-বাবার শাস্তি কে বন্ধ করবেএ জন্য বাড়িটাকে স্বাস্থ্যকর করতে হবেকারণ, একজন শিক্ষক, একজন অভিভাবকও বটেআমাদের স্কুলগুলোতে দুটি বিষয় ঐচ্ছিক আছেএকটি কৃষি এবং অন্যটি গার্হস্থ্য শিক্ষাএর মধ্যে গার্হস্থ্য শিক্ষা শুধু মেয়েদের পড়ানো হয়আমি মনে করি, গার্হস্থ্য শিক্ষাকে আবশ্যিক করা উচিতআর এ স্পর্শকাতর বিষয় পড়ানোর জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে

আব্দুল কাইয়ুম
আমরা সবার আলোচনা শুনলামসবকিছু মিলিয়ে সমাপনী আলোচনা করছেন এম এম নিয়াজ উদ্দিন

এম এম নিয়াজ উদ্দিন
আজ আলোচনার যে বিষয়গুলো এসেছে, তা যেন আমরা সবাই চর্চা করি, বিশেষ করে, গণমাধ্যমগুলো যেন এ বিষয়ে এগিয়ে আসেবাংলাদেশ স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি লাভ করেছেপরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে বিভাগীয় শহরগুলোতে কৈশোর প্রজননস্বাস্থ্য নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করা হয়যেখানে স্কুল, কলেজের শিক্ষক, সরকারি চাকরিজীবী, জনপ্রশাসনের লোক, অভিভাবক এবং কিশোর-কিশোরীদের উপস্থিত রাখা হয়এ কার্যক্রম ইউনিয়ন পর্যায়ে নেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে
পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে যতটা কাজ হওয়া দরকার, হয়তো ততটা হচ্ছে নাব্যাপক কাজ কিন্তু হচ্ছেএ অধিদপ্তরের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছেএখানে দীর্ঘ ১৪ বছরে কোনো নিয়োগ ছিল নাপ্রায় ১৫-২০ হাজার শূন্যপদ ছিল, যার মধ্যে সাত হাজার নিয়োগ দেওয়া হয়েছেশূন্যপদগুলো পূরণ হলে আমরা আরও ব্যাপকভাবে কাজ করতে পারব

আব্দুল কাইয়ুম
আপনাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাইধন্যবাদ সবাইকে


সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো
তারিখ: ২৬-০১-২০১২